নীর-বিন্দু
প্রকাশিত : ১২:১৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
				
					বই ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। খুঁজছিলাম একটা বিশেষ বই। সেটা পাচ্ছিলাম না, কিন্তু যেটা পাওয়া গেলো, সেটা দেখে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সবুজ কাপড়ের মলাটে বইটি প্রায় ৩০ বছর পরে বিবর্ণ হয়ে গেছে। প্রচ্ছদে সুন্দর সোনালী হরফে লেখা ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’। উঁহু, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত আদি ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নয়। সেটা পছন্দ না হওয়াতে বুদ্ধদেব বসু নিজে যেটা সম্পাদনা করেছিলেন সেই ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’। ১৯৬৩ সালের প্রকাশিত মূল সংস্করণটি।
এমন বই হাতে উঠে এলে কার না আহলাদ হয়? কিন্তু বইটা হাতে নিতে নিতেই মনে পড়লো এর অনন্যতা অন্যখানে। ১৯৯০ সালে অক্সফোর্ডে গিয়েছিলাম সপ্তাহ খানেকের জন্যে ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে। ১২ ফেব্রুয়ারীর বিকেলে দেখা করতে গেছি আমার বন্ধু সুধীর আনন্দের সঙ্গে সেইন্ট ক্যাথিরিনস কলেজে। সুধীর পড়ায় সেখানে। বহু গাল-গপ্পের পরে যখন উঠব, তখন সুধীর জানাল যে সে যাচ্ছে নীরদ সি. চৌধুরীর বাড়ীতে একটা বই পৌঁছে দিতে। ‘তুমিও চলো হে’, সুধীরের আমন্ত্রণ। আমি একটু ইতস্তত : করি- নীরদ বাবুকে সবাই ভয় পায়, বাব্বা, যা ক্ষুরধার জিহ্বা ওঁর। সুধীর আমার দ্বিধা টের পায়। ‘বইটা দিয়েই চলে আসবো’, আশ্বস্ত করে আমার বন্ধু আমাকে। ‘আরে ভাই, ৯০ বছরের ওপরে বয়েস, এমন এক কিংবদন্তী তুমি আর কোথায় দেখবে? চলো, চলো। সুধীর তাড়া দেয় আমাকে। উচ্চবাক সুধীরের পাল্লায় পড়লে নিস্তার নেই।
যেতেই হল সুধীরের সঙ্গে নীরদ চৌধুরীর ল্যাথবেরী রোডের বাড়ীতে। গিয়ে দেখি, নীরদবাবু বাড়ীতে নেই, কি একটা কজে একটু বেরিয়েছেন তাঁর এক ছেলের সঙ্গে।.আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন নীরদ বাবুর আর এক পুত্র, যাঁকে সুধীর ‘কীর্তি বাবু’ বলে সম্বোধন করল। ঘরে দেখলাম, শুভ্র কেশের সৌম্যদর্শন এক ভদ্রলোক বসে আছেন। পরানে রক্ত ছলকে উঠল যখন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী - নীরদ বাবু বিশেষ বন্ধু - বিলেতে বেড়াতে এসে দেখা করতে এসেছেন নীরদ বাবুর সঙ্গে।

আমাকে আর পায় কে? ভয়-ডর সব ভুলে বসে গেলাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পাশের কৌচে। দোতলা থেকে চলৎশক্তিরহিত অমিয়া চৌধুরীর নির্দেশ এলো পুত্রের প্রতি - ছেলেদের চা দাও। আমি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে গড় গড় করে বলে গেলাম তাঁর কবিতার প্রতি আমার মুগ্ধতা - ‘উলঙ্গ রাজা’ আমার খুব প্রিয় বই। জানালাম যে ‘অমলকান্তি’ কবিতার প্রথম বেশ ক’লাইন আমি আমার এক লেখার শুরুতেই ব্যবহার করেছি।সলজ্জভাবে প্রায় পুরো কবিতাই আওড়ে গেলাম - শিশুদের যেমন বাড়ীতে আগত অতিথিদের সামনে করতে বলা হয়। তিনি হেসে উঠলেন - এক তরুণের প্রগলভতায় বোধ করি।
তারপর একটুক্ষণ ভেবে আবার আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। মনে হল, কিছু একটা স্মরণ করতে চেষ্টা করছেন। তারপর একটু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আচ্ছা, যতীন (অধ্যাপক যতীন সরকার) কিছুদিন আগে আমাকে একটা লেখা পাঠিয়েছিল - নাম বোধ করি ‘আমার বন্ধু বিমলকান্তি’। ‘আমারই লেখা’ - কথা শেষ করতে দেই না তাঁকে, রীতিমত লাফিয়ে উঠি বলা চলে। ‘ভালো লেগেছিল আমার, খুবই মানবিক, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রসঙ্গে’, বললেন তিনি, ‘সে লেখার শুরুতেই অমলকান্তি কবিতাটির উদ্ধৃতি ছিল, তাই না’? আমি বাকরুদ্ধ।
‘তুমি আমার লেখার এত ভক্ত, তোমাকে তো আমার একটা বই উপহার দেয়ে উচিত, ঠিক কিনা?’ স্মিতহাস্যে বলেছিলেন তিনি।
হাতড়াতে থাকেন তিনি তাঁর ঝোলা। না, নীরেন চক্রবর্তীর কোন বই বেরুল না সেখান থেকে - বেরুল ৩ খানা বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা। ‘আমার বই বোধহয় সব দিয়ে দিয়েছি’, বিব্রত কণ্ঠ তাঁর। ’আচ্ছা আধুনিক বাংলা কবিতা দেই একখানা?’, অনুরোধের স্বরে বলেন তিনি। হেসে ফেলি আমি, বলি, ‘আপনি একটা ছেঁড়া কাগজে সই করে দিলেও ভালো লাগবে আমার’।
বইটির পাতা উল্টে তিনি লিখতে থাকেন। তাঁর শুভ্র কেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিমল করের ‘আমার তরুন লেখক বন্ধুরা ও অন্যান্য’ বইয়ের কিছু কথা মনে পড়ে যায় আমার, ‘কবি নীরেন চক্রবর্তী আমার চেয়ে পাঁচ/ছ বছরের ছোট। তবু তাঁকে আমি দাদা বলি, কারণ তিনি যে বাংলা সাহিত্যের অগ্রগণ্য কবি’।
আজ তাঁর সেই কবেকার লেখাটুকু দেখে আর্দ্র হয়ে ওঠে আমার চোখ। ‘শুভেচ্ছা’ শব্দটি মনকে দ্রব করে, সইয়ে চোখ আটকে যায়। চোখে পড়ে না যে, আমার নামটি লিখতে ভুলে গেছেন তিনি। আমিও তো ভুলে গেছি আমার অতুলনীয় প্রাপ্তির আনন্দে।
বছর দু’য়েক আগে বড়দিনের দিনই চলে গেলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর একটা বই খুঁজতে এসে নেহাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে এই অনিন্দসুন্দর উপহারটি হাতে উঠে এলো - আর খুলে গেলো স্মৃতির ঝাঁপি। আর তখনই ডানদিকে তাকিয়েই পেয়ে গেলাম আমার কাঙ্খিত বইটি - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘নীর-বিন্দু’। আজ ওটাই পড়ব, আগেই ভেবেছিলাম।
এসএ/
 
				        
				    









